বাংলাদেশের প্রাণিসম্পদ খাতে দুম্বা পালন একটি উদীয়মান ও লাভজনক উদ্যোগ হিসেবে গড়ে উঠছে। দুম্বা (Dumba) মূলত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে জনপ্রিয়, তবে বর্তমানে বাংলাদেশের অনেক খামারি এর চাষ শুরু করেছে। দুম্বা পালনে কম খরচে বেশি লাভ করা যায় এবং এদের মাংস ও পশমের চাহিদা বাজারে দিন দিন বাড়ছে। “খাদিজা এগ্রো ফার্ম”-এও দুম্বা পালন একটি লাভজনক উদ্যোগ হিসেবে গড়ে তোলা যেতে পারে। এই নিবন্ধে আমরা দুম্বা পালনের সকল ধাপ বিশ্লেষণ করবো।
ভূমি ব্যবস্থাপনা এবং অবকাঠামো
দুম্বা পালনের জন্য একটি ভালো ভূমি ও সঠিক অবকাঠামো অপরিহার্য। দুম্বা সাধারণত শুকনো ও প্রাকৃতিক পরিবেশে থাকতে পছন্দ করে। খামার পরিকল্পনার জন্য নীচের বিষয়গুলো বিবেচনা করতে হবে:
১. জমির আকার এবং ব্যবস্থা:
– প্রতি ১০টি দুম্বার জন্য প্রায় ১ বিঘা জমি প্রয়োজন হয়। জমি শুকনো এবং উঁচু স্থানে হতে হবে, যাতে বৃষ্টির পানি জমে না থাকে।
– জমির চারপাশে একটি সুরক্ষিত বেড়া দিতে হবে, যাতে দুম্বা গুলো বাইরে না যেতে পারে এবং শিকারি প্রাণীদের হাত থেকে নিরাপদ থাকে।
২. আবাসন বা শেড নির্মাণ:
– দুম্বার জন্য শেড নির্মাণে কাঠ, টিন বা বাঁশ ব্যবহার করা যেতে পারে। শেডটি এমনভাবে তৈরি করতে হবে, যাতে পর্যাপ্ত বাতাস চলাচল করতে পারে এবং সূর্যের আলো প্রবেশ করতে পারে।
– শেডের ভিতর শুকনো মেঝে রাখতে হবে, যা নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে।
ঘাস চাষ এবং খাদ্য সরবরাহ
দুম্বার প্রধান খাদ্য হলো ঘাস ও অন্যান্য প্রাকৃতিক খাদ্য। দুম্বাকে পুষ্টিকর খাদ্য সরবরাহ করতে ঘাস চাষ এবং অতিরিক্ত খাবারের ব্যবস্থাপনা জরুরি।
১. ঘাসের প্রকার এবং চাষ:
– নেপিয়ার ঘাস, বারমুডা ঘাস, গিনি ঘাস ইত্যাদি পুষ্টিকর ঘাস দুম্বার জন্য উপযুক্ত।
– ১ বিঘা জমিতে ঘাস চাষ করে প্রায় ২০-৩০টি দুম্বার খাদ্য সরবরাহ করা যায়। ঘাস সাধারণত ২-৩ মাসের মধ্যে চাষের উপযোগী হয়ে যায়।
২. অতিরিক্ত খাদ্য:
– দুম্বাকে ঘাসের পাশাপাশি অন্যান্য খাদ্য যেমন খৈল, ভুসি, এবং শাকসবজি সরবরাহ করতে হবে।
– দুম্বার গর্ভাবস্থায় এবং শীতকালে অতিরিক্ত পুষ্টিকর খাবারের প্রয়োজন হয়, তাই তাদের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য মজুদ রাখতে হবে।
রোগওচিকিৎসা
দুম্বার স্বাস্থ্যের প্রতি খেয়াল রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ বিভিন্ন রোগ তাদের উৎপাদনশীলতা কমিয়ে দিতে পারে।
১.রোগেরলক্ষণ:
– সাধারণত দুম্বায় যে রোগগুলো দেখা যায় তা হলো: ক্ষুরা রোগ, পরজীবী সংক্রমণ, নিউমোনিয়া এবং কৃমির সমস্যা।
– রোগের লক্ষণগুলো হলো খাবার না খাওয়া, দুর্বলতা, শ্বাসকষ্ট, দাঁতের সমস্যা ইত্যাদি।
২. প্রতিরোধ এবং চিকিৎসা:
– দুম্বাকে নিয়মিত টিকাদান করতে হবে। যেমন ক্ষুরা রোগ প্রতিরোধের জন্য FMD ভ্যাকসিন প্রয়োজন।
– দুম্বার ঘাস এবং জলাশয় পরিষ্কার রাখা উচিত, যাতে সংক্রমণ না ছড়ায়।
– ভেটেরিনারি ডাক্তারদের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ এবং টিকা দেওয়া উচিত।
ঝুঁকি এবং সমাধান
দুম্বা পালন করতে গেলে কিছু ঝুঁকি থাকতে পারে, তবে সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এসব ঝুঁকি সহজেই মোকাবিলা করা যায়।
১.আবহাওয়া:
– অতিরিক্ত গরম বা শীত দুম্বার স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। শীতকালে তাদের জন্য গরম শেড এবং গ্রীষ্মকালে ঠান্ডা পানির ব্যবস্থা রাখা জরুরি।
২. রোগ বালাই:
– ক্ষুরা রোগ, নিউমোনিয়া, এবং পরজীবী সংক্রমণ দুম্বার জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি। এসব রোগ নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত টিকা ও চিকিৎসা দিতে হবে।
৩. খাদ্যের অভাব:
– শুষ্ক মৌসুমে ঘাসের অভাব দেখা দিতে পারে, তাই সময়মত ঘাস চাষ করে বা অন্য খাদ্য সংগ্রহ করে মজুদ রাখা উচিত।
খরচ এবং আয়ের হিসাব
দুম্বা পালনের জন্য প্রধানত যে খরচগুলো হয় তা হলো জমি, শেড নির্মাণ, ঘাস চাষ, খাদ্য, এবং চিকিৎসা খরচ।
১. প্রাথমিক খরচ:
– জমি লিজ বা ক্রয় এবং শেড নির্মাণে বড় খরচ হতে পারে। প্রতি বিঘা জমির জন্য প্রায় ২০,০০০ টাকা লিজ খরচ হতে পারে, এবং শেড নির্মাণে ৫,০০,০০০-৬,০০,০০০ টাকা খরচ হতে পারে।
২. মাসিক খরচ:
– প্রতি মাসে খাদ্য ও ওষুধের জন্য প্রায় ১০০,০০০-১,২০,০০০ টাকা খরচ হতে পারে।
– এছাড়াও শ্রমিক খরচ রয়েছে, যা ১৮,০০০-২০,০০০ টাকা হতে পারে।
৩.লাভেরহিসাব:
– একটি দুম্বার গড় বাজার মূল্য ৪০,০০০ থেকে ৫০,০০০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। গর্ভবতী দুম্বার বাচ্চা বিক্রি করে অতিরিক্ত লাভ করা যায়।
– এছাড়া দুম্বার মাংস ও পশম বিক্রি করেও ভালো আয় করা সম্ভব।
লাভের হার এবং বিনিয়োগের সম্ভাবনা
দুম্বা পালন প্রকল্প থেকে বছরে প্রায় ৬০% থেকে ৮০% পর্যন্ত লাভ করা সম্ভব। এটি নির্ভর করবে সঠিক ব্যবস্থাপনা, দুম্বার স্বাস্থ্য এবং বাজারজাতকরণের উপর।
১. বার্ষিক মুনাফা:
– যদি একটি দুম্বা প্রতি বছরে ২টি বাচ্চা জন্ম দেয় এবং প্রতিটির বাজার মূল্য ৫০,০০০ টাকা হয়, তবে ১০০টি দুম্বা থেকে বছরে প্রায় ৭০-৮০ লাখ টাকা আয় করা সম্ভব।
– এছাড়া দুম্বার পশম বিক্রি করেও প্রায় ২-৩ লাখ টাকা আয় করা সম্ভব।
উপসংহার
বাংলাদেশে দুম্বা পালন একটি উদীয়মান এবং লাভজনক খাত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। সঠিক ব্যবস্থাপনা, রোগ প্রতিরোধ এবং বাজারজাতকরণের মাধ্যমে দুম্বা পালন থেকে উল্লেখযোগ্য লাভ করা সম্ভব। “খাদিজা এগ্রো ফার্ম” এর দুম্বা পালন প্রকল্প দেশের প্রাণিসম্পদ খাতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে, যা দেশের অর্থনীতি এবং খাদ্য নিরাপত্তায় অবদান রাখতে পারে।